দেশে আসা রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের দুটি ভিন্ন বিনিময় দর বেঁধে দেওয়ায় আন্ডার-ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে অর্থপাচার বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা।
এতে অনেক রপ্তানিকারক রপ্তানি আয় রেমিট্যান্স হিসেবে প্রদর্শন করে দেশে এনে তার ওপর দেওয়া নগদ প্রণোদনার সুবিধাও অন্যায্যভাবে নেবেন বলে জানান তারা।
দেশে আসা রেমিট্যান্স টাকায় রুপান্তরের ক্ষেত্রে প্রতিডলারে ১০৮ টাকা এবং রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিতিশীলতা কমাতে নেওয়া হয় এ সিদ্ধান্ত।
রপ্তানিকারকদের মতে, এই ধরনের একক হার রপ্তানিকারক, আমদানিকারক এবং দীর্ঘমেয়াদে রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্য কোনো সুবিধা বয়ে আনতে পারবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক আরও বলেছেন, নির্দিষ্ট এই হার দীর্ঘ সময় কার্যকর থাকলে এটি রপ্তানি আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে; কারণ কিছু রপ্তানিকারক ডলার থেকে আরও মুনাফা করার বিকল্প উপায় খুঁজে বের করবে।
তারা আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, যেসব রপ্তানিকারকের অফশোর অফিস রয়েছে– তারা তাদের আয়ের একটি অংশ সেখানে রাখতে পারে বা রেমিট্যান্স হিসাবে সেই অংশ দেশেও আনতে পারে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) ভাইস-প্রেসিডেন্ট রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, সদ্য নির্ধারিত ডলারের হারের একমাত্র সুবিধাভোগী হলো- ব্যাংকগুলো– রপ্তানিকারকরা এর ফলে তাদের সাথে দর কষাকষির সুযোগ হারিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমি প্রতি ডলারের বিনিময়ে ১০৬ টাকা পেতাম, এখন তা ৯৯ টাকায় নেমে এসেছে- যা যৌক্তিক নয়’।
তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে কোনো রপ্তানিকারক খুব প্রয়োজন নাহলে রপ্তানি আয়ের বিনিময় করবে না। ‘বর্তমান নিয়মে আমাদের রপ্তানি আয় ৩০ দিন সংরক্ষণ করার সুযোগ রয়েছে, আমরা ততোদিন অপেক্ষা করব’- যোগ করেন রকিবুল।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, বেশিরভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয় রপ্তানিকারকদের হাত ধরে। তাহলে তাদের ওপর কেন এই বৈষম্যমূলক হার চাপিয়ে দেওয়া হবে? এটি অন্যায্য।
রপ্তানি আয়ের ডলার টাকায় নগদায়নের ক্ষেত্রে যেসব ব্যাংক উচ্চ দর দিতে রাজি ছিল–তাদের কাছেই বিক্রি করার ক্ষেত্রে সীমা তুলে দিতে রপ্তানিকারকরা যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন– তার মধ্যেই একক দর নির্ধারণ আঘাত এসেছে রপ্তানি খাতে।
‘ডলার বাণিজ্যের জন্য আমরা মুক্তবাজার চাই। নির্দিষ্ট দর কোনো ভালো আইডিয়া নয়। ডলারের দর নির্ধারণ এমনভাবে করা উচিত নয়, যাতে হিতে বিপরীত হতে পারে’।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে কিছুটা চাপমুক্ত রাখতে তিনি ভোক্তাপণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধও করেন।
শাশা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, ‘মুদ্রার অবমূল্যায়ন একটি ভালো পদক্ষেপ, কিন্তু তা আমাদের আরও আগেই করা দরকার ছিল। তাহলে আমাদের বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না’।
ডলারের একক দর নির্ধারণ এরমধ্যেই তাদের ওপর ত্রিমুখী চাপ সৃষ্টি করেছে– এতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ ৩০ শতাংশ বেড়েছে, রপ্তানি আয়ও কম হবে এবং আগের প্রাক্কলনের চেয়ে নতুন বিনিয়োগের খরচও বেশি হবে, উল্লেখ করেন তিনি।
শামস মাহমুদ জানান, সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলে রপ্তানিকারকদের স্থানীয়ভাবে ক্রয় করতেও বেশি খরচ করতে হবে।
এর আগে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘বাফেদার নির্ধারিত ডলারের একক দরটি অদ্ভুত হওয়ায় এটি কার্যকর করাও জটিল হবে। কিছু ব্যাংকে রপ্তানি আয় প্রবাহ বেশি আসবে, অন্যদিকে কিছু ব্যাংকে বেশি নগদায়ন হবে। এর ফলে যিনি বেশি রপ্তানি আয় আনছেন, তার এলসি নিষ্পত্তির রেটও বেশি হবে। অথচ, গ্রাহকরা সেখানেই যান যেখানে রেট কম থাকে’।
তিনি বলেন, রেমিট্যান্স সংগ্রহ এবং রপ্তানির বিল নগদায়নের মধ্যে ব্যবধান ৯ টাকা । এরফলে, রপ্তানি খাত আন্ডার-ইনভয়েসিং এর ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
‘রপ্তানিকারকরা যদি আন্ডার-ইনভয়েসিং করেন এবং রেমিট্যান্স হিসেবে রপ্তানি আয় আনেন, তাহলে তারা প্রতি ডলারের বিপরীতে ৯ টাকা বেশি পাবেন, তার সাথে পাবেন আরও ২.৫ টাকার নগদ প্রণোদনা। এতে আন্ডার-ইনভয়েসিং এর নতুন রাস্তাও তৈরি হবে’।
জাহিদ হোসেন বলেন, আন্ডার-ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে এখন অর্থপাচারও হবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মুদ্রাবাজারে ডলারের সরবরাহ ও ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা হবে–তা স্পষ্ট নয়।